বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের বিভক্তি এখন প্রকাশ্যে। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, তাদের মধ্যে বিভক্তি আরও গভীর হচ্ছে।আর এ সুযোগ কাজে লাগাতে কৌশলী হচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী। এদিকে নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী না থাকার সুযোগে আওয়ামী লীগের বিরোধী পক্ষের কাঁধে ভর করে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান তারা। আর এই সমীকরণ নিয়েই নগরময় এখন আলোচনার রব উঠেছে। যদিও মহানগর আওয়ামী লীগ বলছে, মতের বিরোধ থাকলেও তার প্রভাব পড়বে না নির্বাচনে। শেষ পর্যন্ত দলীয় প্রার্থীর পক্ষেই থাকার কথা জানিয়েছেন তারা।
জানা গেছে, ‘বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্বে ছিলেন সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও দলের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে একক প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রে প্রস্তাবনা পাঠায় মহানগর আওয়ামী লীগ।
তবে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয় শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ছোট ছেলে ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছোট ভাই আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতকে। এরপরই সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর বিরোধী শিবিরের নেতা-কর্মীরা রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এ নিয়েই বিভক্তির শুরু হয় মহানগর আওয়ামী লীগে। যা প্রকাশ্যে আসে গত ১ মে মহান মে দিবসে আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে। ওই দিন সকালে দলীয় কার্যালয়ের সামনে জেলা ও মহানগর শ্রমিক লীগের ব্যানারে শ্রমিক সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করেন মেয়র প্রার্থী আবুল আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের অনুসারীরা। বিকেলে একই স্থানে আলাদা মঞ্চ করে পাল্টা সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করে মহানগর শ্রমিক লীগের অপর অংশ। যে অংশটি সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এদিকে, গত ২ মে আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু করেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। এ দিন বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে শুরু করে চকবাজার এলাকায় গণসংযোগ করেন তিনি। তবে আনুষ্ঠানিক গণসংযোগ শুরুর দিনে তার পাশে দেখা যায়নি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী মহানগর বা জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের।
শুধুমাত্র মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আফজালুল করিম এবং জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি শাহজাহান হাওলাদারসহ পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী অনুসারীরা ছিলেন খোকন সেরনিয়াবাতের সাথে। একই দিন নগরীর ডিসি ঘাট এলাকায় মে দিবসের কর্মসূচিতে অংশ নেন খোকন সেরনিয়াবাত। এছাড়া বিকেলে প্রধান নির্বাচন কার্যালয়ে ওলামা লীগের সাথে মতবিনিময় করেন তিনি। সেখানেও আওয়ামী লীগের বিরোধী পক্ষের দেখা মেলেনি।
অপরদিকে, ‘বুধবার আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আফজালুল করীম। এসময় মহানগর শ্রমিকলীগের সভাপতি আফতাব হোসেন, যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান মামুন থাকলেও সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারীরা ছিলেন না। এর আগে গত ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির অনুমোদন দেন মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। সেখানে সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরন এবং পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম অনুসারীরা স্থান পেলেও রাখা হয়নি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ বা তার অনুসারী নেতা-কর্মীদের।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পরে গত ২০ এপ্রিল কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে নিয়ে বরিশালে আসেন খোকন সেরনিয়াবাত। ওইদিন দলীয় কার্যালয়ের সামনে মেয়র প্রার্থীকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম জাহাঙ্গীর। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুসসহ মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারীরা উপস্থিত ছিলেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দলের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোনীত মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে থেকে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করার ঘোষণা দেন তাঁরা। তবে এরপর নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে কোন কার্যক্রমে দেখা যাচ্ছে না তাদের। এমনকি মহানগর আওয়ামী লীগের অধিনস্ত ৩০টি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদেরও দেখা মিলছে না দলীয় প্রার্থীর প্রচার-প্রচারনায়। দলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, ‘নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, বিরোধ ততটাই কঠিন হচ্ছে।
অপরদিকে, এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নানা নাটকীয়তার পর প্রার্থী ঘোষণা করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। গত ২৭ এপ্রিল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমের নাম ঘোষণা করা হয় প্রার্থী হিসেবে।
জানা গেছে, ‘মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম ২০০৮ সালের বরিশাল সদর আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৭ হাজারেরও বেশি ভোট পান। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তাঁর প্রার্থী হওয়ার কথা ছিলো। অপরদিকে, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীর আলোচনায় ছিলেন দলটির কেন্দ্রীয় সভাপতিম-লীর সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন এবং চরমোনাই পীরের আরেক ভাই ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ছাত্র এবং যুব বিষয়ক সম্পাদক মুফতি সৈয়দ এছহাক মুহাম্মাদ আবুল খায়ের। এদের মধ্যে আবুল খায়ের চরমোনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। সিটি নির্বাচনে প্রার্থী করার জন্য গেলো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করেননি তিনি।
কিন্তু হঠাৎ আলোচনায় থাকা দুই প্রার্থীকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেয়া হয় চরমোনাই পীরের মেঝ ভাই ও দলের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমকে। প্রার্থী মনোনয়নে দলটির এ নাটকীয়তা রহস্যজনক মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং আওয়ামী লীগের একাংশের নেতারা। তাছাড়া যিনি সংসদ সদস্য নির্বাচনের প্রার্থী তিনি সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় সেই রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে। দলীয় নেতারা মনে করছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও তাঁর চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। সেই বিরোধ কাজে লাগাতেই ফয়জুল করীমকে নির্বাচনে প্রার্থী করা হতে পারে। আর এই সিদ্ধান্ত কোন পক্ষের সবুজ সংকেতেও হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
তবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, বরিশালে আমাদের প্রার্থী দেয়ার সিদ্ধান্ত বহু আগে থেকেই। আমি নিজে নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার। আসলে নির্বাচনী মাঠে আমাদের শক্ত অবস্থানে ভীত হয়ে এসব অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে। আমরা বরিশালের আপামর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনব ইনশাআল্লাহ। অপরদিকে, আগে থেকেই বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন মহানগর জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপস। গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি। তবে তাতে সুবিধা করতে না পারলেও এবার বিএনপির মাঠে না থাকা এবং আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কাজে লাগাতে চান তিনি। তাছাড়া আওয়ামী লীগের বিরোধী ভোট তার পক্ষে থাকবে এমনটাও বলছেন অনেকে।
আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য লস্কর নুরুল হক বলেন, ‘আমাদের মেয়র প্রার্থীর সাথে আওয়ামী লীগ নেতারা নেই সেটা ঠিক না। আমরা যারা আছি তারা সবাই আওয়ামী লীগ। যারা আওয়ামী লীগে বিশ্বাসী তারা কখনো অন্য প্রার্থীকে ভোট দিবে না। সবাই নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে এক কাতারে চলে আসবে।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমরা নৌকার বিপক্ষে নই। নৌকার বিরোধিতার প্রশ্নই আসে না। বরিশালে নৌকার বিজয় হবে। দলীয় প্রার্থীর নির্বাচন কার্যক্রমে কেন দেখা যাচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা আছি, মে দিবসে আমরা শ্রমিকলীগের আয়োজনে অনুষ্ঠান করেছি। অনুষ্ঠান আলাদাভাবে হলেও সেøাগান কিন্তু নৌকার পক্ষেই ছিলো। সেখানে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতকে বিজয় করতে আমরা সেøাগান দিয়েছি।
তবে তিনি দাবি করে বলেন, ‘দলীয় প্রার্থীর নির্বাচন কার্যক্রমে আমাদের রাখা হচ্ছে না, ডাকা হচ্ছে না। এমনকি জানানোও হচ্ছে না। যে কারণে ইচ্ছা থাকলেও আমরা তার কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছি না। তবে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হতে এখনো সময় বাকি আছে। এখন না থাকলেও তখন ঠিকই সবাই প্রচার-প্রচারনায় নামবে বলেন তিনি।