আমাদের নুতন প্রজন্মকে ভালো মানুষ হিসেবে তৈরি করা নিয়ে বিশেষ লেখা)
ফারুক আহমেদ
রাত ১২টা, প্রতিদিনের রুটিন হিসেবে মেয়ে ইশরাত এর সাথে ফোনে কথা বলছি । আজ মেয়ের কথা শুনে আনন্দে মনটাই ভরে গেলো ! মেয়ে বলতে লাগলো, “গতকাল আমি আমার ক্লিনিক থেকে ফেরার পথে, নিউইয়র্কে ম্যানহাটানের “পার্ক এভিনিউ” রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছি, দেখলাম দূর থেকে পঞ্চাশোর্ধ এক মহিলার হাতে একটি প্যাকেজ এবং সে অনেকক্ষন ধরে হাত উঁচু করে বলছে, “নিড হেল্প হেল্প হেল্প” ! কিন্তু কেউ তার ডাকে সারা দিচ্ছে না” !
আমি ওই মহিলার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ ?
— আই নিড হেল্প সেন্ডিং দিজ প্যাকেজ টু মাই সিস্টার, বাট আই ডোন্ট হ্যাভ মানি ফর পোস্টাল এক্সপেন্সেস, উল্ড ইউ প্লিজ হেল্প মি ?
— সিউর আই উইল হেল্প ইউ, টেক দিজ ডলার ফর ইওর পেকেজ সেন্ডিং আউট !
মেয়ে ইশরাত জানালো, ওই মহিলাকে তার প্যাকেজ পাঠানোর খরচ হিসাবে ডলার পে করার পর, সে এতই খুশি হলো যে, সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, “থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ, ইউ আর গ্রেট, গড ব্লেস ইউ এন্ড ইউ উইল বি রিওয়ার্ডেড”!
মেয়ে বলতে লাগলো,
— ওই মহিলার হাসিটা দেখে আমার খুব ভালো লাগলো এবং আমি মনের ভিতর এক অন্য রকম আনন্দ ও প্রশান্তির অনুভব করতে লাগলাম ! মনে হলো, “আজ আমি একটি ভালো কাজ করতে পারলাম, একজন মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাতে পারলাম” ! আরো ভাবতে লাগলাম, “আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চার পাশে কত অসহায় মানুষ আছে, এই ভাবে আমরা মানুষকে একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারি, এই ছোট্ট কাজটি করতে আমাদের আয়ের কিছু অংশ না হয় যাবে, কিন্তু তাতে আমাদের তেমন কোন কষ্ট হবে না, কিন্তু যে মানুষটি এই ছোট্ট হেল্প পেলো, সেটা তার জন্য অনেক বড়ো সাপোর্ট ! এতে মানুষেরও উপকার হলো এবং আমরাও মনে আনন্দ পেলাম” !
মেয়ে ইশরাতের কথা শোনার পর মনে পড়ে গেলো, ছেলে মেয়েদের সেই ছোট বেলার কথা:
ছোট বেলায় আমার ছেলে মেয়ে ইশরাত, আহমেদ, সাফা যখন স্কুলে পড়তো, আমি নিজেই ওদের ড্রাইভ করে স্কুলে নিয়ে যেতাম এবং ক্লাশ শেষে স্কুল থেকে ওদের বাসায় নিয়ে আসতাম !
স্কুল যাওয়ার পথে একটি বড় ট্রাফিক সিগন্যাল, প্রায় দেখা যেতো সেই সিগন্যালে গাড়ি থামানোর পর অনেকেই হাত পেতে আর্থিক সহযোগিতা চাইতো !
আমি ছেলে মেয়েদের সামনে ওই মানুষগুলোকে টাকা দেওয়ার সময়, ওরা সেটাকে নজরে রাখতো এবং পরিবর্তী কালে যখনই কেউ হাত পাততো, তখন ইশরাত, আহমেদ, সাফা ওরা নিজেদের হাত দিয়ে টাকা দিতে চাইতো এবং বলতো, “আব্বু আমি টাকা দিতে চাই”!
তখন আমার মনে হতো, “আমাদের সন্তানদেরকেও মানবিক মানুষ হওয়ার প্রাকটিস করাতে হবে, তাই আমি ওদের হাতে টাকা দিতাম এবং ওরা নিজেদের হাত দিয়ে এইসব অসহায় মানুষকে টাকা দিতো এবং খুব আনন্দ পেতো”। মাঝে মাঝে ওরা বলতো, “আজ আমি আমার টিফিন এর টাকা ওদের দিবো এবং ওরা তাই করতো”। আমিও ওদের এই কাজে উৎসাহিত করতাম !
বাবা হিসেবে আমি এই ভাবেই ওদের মানবিক হওয়ার প্রাকটিস করানো শুরু করি, এর ফলে ওদের ভিতর মানুষের প্রতি এক ধরণের মায়া তৈরি হয়, এবং সুযোগ পেলেই ওরা মানুষকে সহযোগিতা করা শুরু করে !
একই সাথে মানুষের সাথে কিভাবে বিনয়ের সাথে কথা বলতে হয়, ছেলে মেয়েদের ভিতর নম্রতা, ভদ্রতা, শালীনতা, সততা প্রতিটি বিষয় কিভাবে মেইনটেইন করতে হয়; কিভাবে মানুষকে শ্রদ্ধা করতে হয়, তা ওদের শিখাতে লাগলাম । যেমন, বড়দের সম্মান করা ও ছোটদের স্নেহ করা তা ওরা শিখলো ।
ওরা যখনই কোন মার্কেটে যেতো, মানুষকে হেল্প করতে লাগলো । রমজানের সময় বাসায় ওরা ওর আম্মুকে হেল্প করে ইফতার বানিয়ে, ইফতারের সাথে নিজেরা পুটিং বা কেক বানিয়ে তা ইফতারের প্যাকেট বানিয়ে মানুষকে দিতে লাগলো ! ঈদের সময় বন্ধুদের জন্য চকোলেট কিনে বাসায় রাখার অভ্যাস গড়ে উঠলো এবং ঈদের দিনে সব বন্ধুদের চকোলেট দিতে লাগলো ।
মেয়ে ইশরাত তার সকল বান্দবীদের শুভ জন্মদিনের উদযাপন করার জন্য নিজে দায়িত্ব নিয়ে তাদের জন্য কেক ও গিফট এর ব্যাবস্থা করতে লাগলো । এতে ওর ভিতর মানুষের প্রতি দায়িত্বশীলতা এবং টিম ম্যানেজমেন্ট এর জন্য একধরণের গুড লিডারশিপ কোয়ালিটি তৈরি হলো !
দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলে, দেশে পাঠানো; শীতের সময় মানুষের কাছ থেকে পুরানো কাপড় সংগ্রহ করে তা দেশে এবং সিরিয়ার মতো যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের নিকট পাঠানোর ব্যাবস্থা করতে লাগলো ।
এই ভাবেই ওরা মানবিক মানুষ হয়ে উঠতে লাগলো এবং এসব দেখে আমারও খুব আনন্দ লাগলো । একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে তৈরি হওয়ার জন্য আমাদের প্রতিটি প্রজন্মকে এমন মানবিক মানুষ হওয়া একান্ত জরুরী, তা আমি ওদের শিক্ষা দিতে লাগলাম !
আজ মেয়ে ইশরাত পঞ্চাশোর্ধ এক জন মহিলাকে তার একটি প্যাকেজ পাঠাতে যে হেল্প করেছে, তাকে যে আর্থিক সহযোগিতা করেছে এটা জেনে আমি আমার মনের ভিতরে বড়ো ধরণের আনন্দ ও প্রশান্তি অনুভব করলাম । একই সাথে বউকে বলতে লাগলাম, “তোমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে, তোমার ছেলে মেয়েরা আজ শুধু একজন ভালো প্রফেশনাল ব্যাক্তিত্বই হয়নি, ওরা ভালো মানুষও হয়েছে, একজন মানবিক মানুষ হয়েছে ! এটা আমার জন্য বড়ো শান্তির বিষয়, আমি আজ মরে গেলেও আমার আত্মা শান্তি পাবে”!
এরই মাঝে বউ বলতে লাগলো, “অনেক রাত হলো, ঘোমাতে চলো, সকালে অফিস আছে”!
পাদটীকা: একদিন মেয়ে শেয়ার করছিলো, কিভাবে একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলাকে ও হেল্প করেছিলো ওই মহিলার একটি প্যাকেজ তার বোনের কাছে পাঠানোর জন্য ! আমার কাছে মনে হয়েছিল মেয়ে এটা একটি বড় মানবিক কাজ করেছে, সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই গল্পটি লেখা ।
আমরা আমাদের নুতন প্রজন্মকে কেবল শুধু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, সায়িন্টিস্ট তৈরি না করি, আমরা যেন আমাদের প্রতিটি সন্তানকে মানবিক মানুষ হিসেবেও গড়ে তুলি । আমাদের নুতন প্রজন্মকে যেনো মানবিক মূল্যবোধ, ভদ্রতা, নম্রতা, শালীনতা, সততা এবং মানুষকে সম্মান করতে শিক্ষা প্রদান করি । এই দায়িত্ব আমাদের প্রতিটি বাবা মায়ের, যাতে ওরা ভালো মানুষ হয়ে পরিবার সমাজ ও দেশের কল্যানে নিজেদের অবদান রাখতে পারে। এতে আমাদেরও সম্মান বৃদ্ধি হবে এবং আমাদের আগামী নুতন প্রজন্ম একটি সুন্দর ও শান্তিময় পৃথিবী তৈরি করতে অবদান রাখতে পারবে