গত দুই বছরে দুইবার ওষুধের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। তবুও জীবন বাঁচাতে ওষুধ না কিনে উপায় নেই কারো।বরিশালের বসুন্ধরা হাউজিংয়ের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা সাবেরা খাতুন। ষাটোর্ধ্ব এই নারী ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপসহ নানা অসুস্থতায় ভুগছেন। গত তিন মাস আগে একমাসের ওষুধ ১৪০০ টাকায় কিনতেন। কিন্তু বর্তমানে একই ওষুধ কিনতে খরচ হচ্ছে প্রায় ২২০০ টাকা।
প্রতিবার এসে দেখছি কোনো না কোনো ওষুধের দাম বেড়ে গেছে। আমাদের খরচের নির্দিষ্ট একটা হিসাব থাকে। ইদানিং সব জিনিসপত্রের সাথে ওষুধের দামও বেড়ে যাওয়ায় বাজেটের মধ্যে কোনো কিছুই ঠিকঠাক মতো করা সম্ভব হচ্ছে না।
শেবাচিম হাসপাতালের সামনের ওষুধ ফার্মেসি থেকে মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে আসা আলমগীর হোসেন বলেন, আমার মা হার্ট ও ডায়াবেটিসসহ নানা স্থায়ী রোগে ভুগছেন। ফলে নিয়মিত নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ কিনতে হয় তার জন্য।
এ মাসে ২ হাজার ৫৫০ টাকার ওষুধ কিনেছি। গত কয়েক মাস ধরে এর কাছাকাছি খরচ হচ্ছে। অথচ আগে এই ওষুধ কিনতে আমার ১৮০০ টাকা খরচ হতো। তিনি বলেন, সব কিছু বাদ দিলেও খাবার আর ওষুধ তো বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে অন্যদিকে বাজেট কমাতে হচ্ছে।
সাবেরা খাতুন কিংবা আলমগীরের মতো ওষুধ কিনতে ফার্মেসিতে গিয়ে ইমরান হোসেন, আকলিমা বেগম এবং নাসির উদ্দিন খানের একই অভিজ্ঞতা। ক্রেতাদের দাম সংক্রান্ত নানা প্রশ্নে জর্জরিত ফার্মেসি দোকানি থেকে বিক্রয় কর্মীরাও।
সোমবার ও মঙ্গলবার সরেজমিনে নগরীর একাধিক ফার্মেসি ঘুরে জানা গেছে, ডায়াবেটিস থেকে শুরু করে বিভিন্ন রোগের প্রায় সব ওষুধের দামই বেড়েছে। গ্যাস্ট্রিকের একই গ্রুপের ওষুধ ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির দামের মধ্যে বেশ তফাৎ। বেশি প্রচলিত ওষুধগুলোর দাম আগে থেকেই বেশি। সেগুলোর দাম স্থির থাকলেও একই গ্রুপের অন্য ওষুধের (কম প্রচলিত) দাম কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ফার্মেসি সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, ২০২১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দুই বছরে দুইবাবে ওষুধের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এর মধ্যে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ক্যালবো-ডি এখন বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়। যা ছিল ২১০ টাকা, ভিটামিন নিউরো -বি ২৪০ টাকা ছিল, এখন ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া ডায়াবেটিসের ওষুধ সেফরিন ট্যাবলেট ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা আগে ছিল ৮০ টাকা। অপরদিকে শিশুদের জ্বর-সর্দিতে নাপা সিরাপটির প্রায় দ্বিগুণ দামে কিনতে গিয়ে দিশেহারা নি¤œবিত্ত মানুষ। ২১ টাকার নাপা সিরাপ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। যা একেবারেই অস্বাভাবিক বলে দাবি সাধারণ মানুষের।
একইভাবে এজমার সমস্যায় ঠা-া ও কাশির ট্যাবলেট মোনাস বিক্রি হচ্ছে ২৬২ টাকায়। যা দাম ছিল ২৪০ টাকা। জ¦র, কাশির জন্য এন্টিবায়েটিক ট্যাবলেট সেফ-থ্রি ২৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা ছিল ২১০ টাকা।
অপরদিকে উচ্চ রক্তচাপের জন্য ৮০ টাকা দামের ট্যাবলেট ওসারটিলের দাম চলতি বছরে বেড়ে ১০০ টাকা, ডায়েরিয়ায় ব্যবহৃত ম্যাট্রিল ট্যাবলেট ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ২০ টাকা, গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসার ক্যাপসুল সেকলোর দাম পাতা প্রতি বেড়েছে ২০ টাকা।
এছাড়া ৬০ টাকার ফিকজোকার্ড ৮০ টাকা, এজমার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ৬০ টাকার ডোক্সিভা এখন ৮০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
অপকফ ১০০ টাকার সিরাপ বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়। শুধু তাই নয়, কমদামী বলে পরিচিত ওষুধগুলোর দামও বৃদ্ধি পেয়েছে দেদারসে। ঠা-ার ওষুধ হিসটাসিন, পিরিটনের দামও বেড়েছে সমানতালে। এদিকে অভিযোগ রয়েছে, অনেক ট্যাবলেট ও সিরাপের পরিমাণে আগের তুলনায় দেয়া হচ্ছে।
তবে অভিযোগটি সত্য নয় বলে দাবি করে নগরীর রূপাতলী এলাকার খুচরা ওষুধ বিক্রয়কারি মিজান ড্রাগর্স হাউজের মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ট্যাবলেটের মিলিগ্রাম কমানোর কোন সুযোগ নেই। যদিও কম থাকে তাহলে সেটা কোম্পানি ভালো বলতে পারবেন। তিনি বলেন, ওষুধের দাম নিয়ে প্রতিনিয়ত ক্রেতাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।
দাম তো আসলে আমার নির্ধারণ করি না। আর খুচরা বিক্রেতা হিসেবে কোনো ওষুধের দাম ইচ্ছামতো কম-বেশি করার কোনো সুযোগ আমাদের নেই।
গত ২০ বছর বান্দরোডে লিমন মেডিকেল হল পরিচালনা করছেন লিমন খান। তিনি বলেন, ২০ বছরের অভিজ্ঞতায় ওষুধের দাম এত ঘনঘন বৃদ্ধি পেতে আগে কখনো দেখিনি। তিনি জানান, গত দুই বছর ধরেই ১০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে কোনও কোনও ওষুধের দাম।
সাগরদীর ঈশান মেডিকেল হলের মালিক জাবের হোসেন বলেন, ওষুধের দাম বৃদ্ধির কোনও সুনির্দিষ্ট কারণ বা সময় কখনও দেখিনি। মাস শেষ হবার একদিন আগে এসে তারা জানিয়ে যায়, পরবর্তী মাসের প্রথম থেকে ওষুধের দাম বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, কোনও কোম্পানি তাদের একটি দাম বাড়ালে আরেক কোম্পানি তাদের আরেকটি ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। আর এভাবে প্রায় সব ধরনের ওষুধের দামই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে জীবন রক্ষাকারী এসব ওষুধের দাম।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বরিশাল জেলার সভাপতি হিরন কুমার দাস বলেন, এটি খুবই অস্বাভাবিক একটা অবস্থা। বিশেষ করে যে মেডিসিনগুলো সবসময় প্রয়োজন হয়, যেমন ডায়াবেটিস বা ইনসুলিন সংক্রান্ত যে ওষুধগুলো আছে, এগুলোর দাম নিয়মিত বাড়ছে। ওষুধ কোম্পানিগুলো ধারাবাহিকভাবে সেই দাম বৃদ্ধি করছে। মাসের শুরুতে যে দাম, মাস শেষে দেখা যায় তা পরিবর্তন হয়ে বেড়ে গেছে। কিন্তু এদের লাগাম টানার কেউ নেই। ওষুধ কোম্পানির মধ্যে সততা মানবতাও নেই।
তাঁর অভিযোগ, এখানে ঔষধ প্রশাসনের তেমন নজরদারি নেই। এদের বিরুদ্ধেও ঘুস লেনদেনের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তাই ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ধরনের নজরদারি প্রয়োজন, তারা তা করছে না। এটি না থাকার কারণে কোম্পানিগুলো আইনের নানা ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিপরীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
এ বিষয়ে বরিশাল জেলা ফার্মেসি মালিক সমিতির সভাপতি আকতারুউজ্জামান গাজী হিরু জানান, সরকার নির্ধারিত দামেই ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে। তবে কোম্পানির দামের ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার থাকে না। তারপরেও ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে সব ফার্মেসি মালিকদের সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ বিক্রি করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেউ অমান্য করলে তার দায় সমিতি নিবেন না নির্দেশনায় বলা আছে।
এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ইন্দ্রানী দাস বলেন, ফার্মেসিতে অভিযান চলমান রয়েছে। বিভিন্ন সময় অতিরিক্ত দাম, মেয়াদউর্ত্তিণ ওষুধ বিক্রি করার অপরাধে জরিমানাও করা হচ্ছে।
গণমাধ্যম, ঝালকাঠি, দেশজুড়ে, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, বরিশাল, বরিশাল বিভাগ, ভোলা, মেইন লিড, শিক্ষা, শিরোনাম, সাব-লিড, স্বাস্থ্য