অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনা, বাগ্বিতণ্ডা ছাপিয়ে আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যদিও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো, অনেক যুগ রাজনৈতিক মাঠে থাকা বাম দলের বহুলাংশ এবং কথিত দক্ষিণপন্থী ইসলামিক ভাবাপন্ন দলগুলো (যার মধ্যে অনেকগুলোই নিবন্ধনহীন) তত্ত্বাবধায়ক অথবা নিরপেক্ষ সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করেছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকা দলগুলো তাদের দাবির সপক্ষে জনসমাগম ঘটানোর কৌশল নিয়েছিল। এই বাস্তবতায় অনেকেই মনে করেছিলেন যে এবার হয়তো গণতন্ত্র ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে উভয় পক্ষের মধ্যে কোনো ধরনের বোঝাপড়া হতে পারে। কারণ, রাজনীতি দেশের ও মানুষের কল্যাণের জন্য, অকল্যাণ ডেকে আনার জন্য নয়। সে আশার গুড়ে বালি পড়ে ২৮ অক্টোবর পল্টন এলাকায় এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ জনসমাবেশ ঘটানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা পণ্ড হওয়ার মধ্য দিয়ে।
২৮ অক্টোবরের ঘটনা নির্মোহভাবে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে থাকবে। প্রশ্ন থাকবে যে এত বড় একটি দল, বছরখানেক ধরে রাজপথের কথিত আন্দোলন গড়ে তোলার পর প্রায় শেষ পথে এসে কেন এমন কাণ্ড করতে গেল? এ ঘটনা নিয়ে জনসাধারণের বিচার-বিশ্লেষণ থেমে নেই। এমনকি আন্তর্জাতিক মহল, যারা বাংলাদেশে একটি উদার গণতন্ত্র দেখতে চায় বলে দাবি করে তারাও এ নিয়ে বিচার–বিশ্লেষণ করছে। আমার ধারণা ছিল, রাজপথের বিরোধী দল সরকার থেকে ন্যূনতম আশ্বাস পেলে হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিত। আমার এ ধারণা পুরো ভুল হতে পারে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে।
আগামী নির্বাচন যে মডেলে হতে যাচ্ছে, তা আগের দুই নির্বাচনের মডেল ও পরিপ্রেক্ষিতের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এ মডেল খুব একটা ভিন্নতর বা এর আগে দেখা যায়নি তেমন নয়। ১৯৮১ থেকে ১৯৯১—এই এক দশকে এমন ধাঁচের নির্বাচন এ দেশের হয়েছে। তবে এবারের নির্বাচনের মডেল আরেকটু ভিন্নতর। ঘোষণা দিয়ে সরকারি দলের ‘ডামি’ প্রার্থী (ডামির বাংলা নকল) দাঁড় করিয়েছে এবং একই সঙ্গে কথিত স্বতন্ত্র, একই দলের, অথবা সহযোগী দলের প্রার্থীদের দাঁড় করানো হয়েছে। এ নির্বাচনে আরেকটি নতুন বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় হচ্ছে, কথিত তৃতীয় বৃহত্তর দল হিসেবে পরিচিত, ছোট ছোট দল, নতুন গজিয়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারি দলের কাছে বিজয়ের নিশ্চয়তা প্রার্থনা করছে। এ জন্য তারা সরকারি দলের প্রতীক ব্যবহার থেকে শুরু করে সরকারের কাছ থেকে নানা সহায়তা পেতে মরিয়া। না পেলে অভিমান করার ঘটনাও ঘটছে। সরকার যেহেতু আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপে রয়েছে, তাই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে এই কৌশল নেওয়া হয়েছে। কিছু নতুন দল যে ধরনের প্রতীক ও নাম ধারণ করেছে, তাতে মনে হয়েছিল বড় বিরোধী দল ভেঙে সদস্যরা ছোট ছোট দলে যোগ দিয়ে দল ভারী করবে। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি। যে কয়েকজন এসেছেন সরকারি দলের অনুকম্পা ছাড়া তাঁদের অনেকেই জামানত হারাতে পারেন। এ পর্যন্ত যে পরিস্থিতি বা চিত্র ফুটে উঠেছে, তাতে মনে হয় সরকারের সমর্থন নিয়ে জয় নিশ্চিত করতে না পারলে এসব দল অস্তিত্বসংকটে পড়বে। জাতীয় পার্টিও এর বাইরের নয়। কারণ, জাতীয় পার্টিও নিজের শক্তিতে নয়, সরকারি দলের অনুকম্পার আবর্তে ঘুরছে। এখন যে ছোট দলগুলো আসনের জন্য সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষি করছে, নির্বাচনের পর সেই দলগুলোর অস্তিত্বসংকটে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। কাজেই এ নির্বাচনের পর এসব দলের, এ দেশের বৃহৎ রাজনীতির মাঠে খেলোয়াড় হিসেবে আদৌ থাকতে পারবে বা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
শুধু নির্বাচনের পরই নয়, নির্বাচনের প্রাক্কালেও এসব দলের অনেকগুলোর মধ্যে অস্থিরতা পরিলক্ষিত। জাতীয় পার্টি দৃশ্যত দুই ভাগ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে কল্যাণ পার্টি ঘটা করে পার্শ্ব পরিবর্তন করে সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষি অথবা আশ্বস্ত হয়ে নির্বাচনে যোগ দেওয়ার ঘোষণার দুই সপ্তাহের মধ্যে বিদ্রোহের কবলে পড়েছে। বিদ্রোহের ফল হলো, কল্যাণ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীককে দল থেকেই বহিষ্কার করেছে দলের একাংশ।
শুধু ছোট ছোট বা অন্যান্য দলই নয়। এই নির্বাচনের পর প্রধান বিরোধী দল বলে বিবেচিত বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিবিধি কেমন হবে, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। যদিও বিএনপিতে অনেক তরুণ নেতৃত্বের সমাবেশ হয়েছে কিন্তু অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের অভাবে দলের ভবিষ্যৎ চেহারা কেমন থাকবে, তা বলা সহজ নয়। আগামী পাঁচ বছর দলকে টিকে থাকতে হলে গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারায় তা কতটুকু সম্ভব হবে, সেটাও এক বড় প্রশ্ন।
এ নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু অন্য দলগুলোই নয়, চারিত্রিক পরিবর্তনের মুখে পড়তে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। একটানা ২০ বছর ক্ষমতায় থাকা এই দলে বিত্তবান, ব্যবসায়ী এবং সুবিধাবাদী অনেকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, যে কথা প্রায়ই দলের মহাসচিবের মুখে উচ্চারিত হয়েছে। তাতে প্রকৃত ত্যাগী রাজনৈতিক নেতাদের অভাব যেমন এখনই দেখা দিয়েছে, ভবিষ্যতে হয়তো আরও প্রকট হবে।
বঙ্গবন্ধুর দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ছিল মধ্যবিত্তদের দল এবং তাদের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম হয়েছে। এর আগে নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা পাকিস্তানের অত্যন্ত শক্তিশালী শাসকচক্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে। নেতারা ছিলেন ত্যাগের উদাহরণ। গবেষকদের মতে, এখন এই দলে বিত্তবান এবং সাবেক আমলাদের উত্থান ঘটেছে। এবারের যাঁরা মনোনয়ন পেয়েছেন, তা বিবেচনায় নিলেও এমনটি প্রতীয়মান হয়। কাজেই আগামীর আওয়ামী লীগ কেমন হবে, তা হয়তো নির্বাচনের পরে প্রত্যক্ষ করা যাবে।
আগামী নির্বাচনের পর বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে যে বড় ধরনের পরিবর্তন হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বঙ্গবন্ধুর প্রণীত বৈদেশিক নীতির ভিত্তি অটুট থাকবে কি না, সেটাও বড় প্রশ্ন মনে হয়।
এই নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গতিপ্রকৃতি কী হবে, কোন দিকে যাবে, তা পর্যবেক্ষণ এবং হতে পারে মৌলিক গবেষণার বিষয়। এর মধ্যে প্রধান প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা। এই নির্বাচনের ব্যবস্থাপনায় কমিশন বহু পদক্ষেপ নিলেও আপামর জনসাধারণের আস্থা ফিরবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাবে।
আগামী নির্বাচনের পর, যার ফলাফল সবারই জানা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কেমন হয়, তা শুধু লক্ষণীয় নয়, বড় ধরনের গবেষণার বিষয় হতে পারে।